সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

২৮ অক্টোবর আওয়ামী বর্বরতার কালো অধ্যায়

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনেক দিবস আছে যেগুলো আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা যখনি হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, আর এপ্রিল ফুল দিবসের কথা স্মরণ করি, আমাদের স্মৃতিতে এক জঘন্য চিত্র ভেসে ওঠে। তেমনি ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করলে আওয়ামী লীগ বৈঠার হিংস্রতা পৈশাচিকতা, আর বর্বরতার এক বীভৎস চিত্র আমাদের নতুন প্রজন্মেও নিকট ফুটে ওঠে, যাতে শিউরে ওঠে শরীর, বাকরুদ্ধ হয় বিবেক, কেঁদে ওঠে মানুষের মন। আর এই মানুষরূপী নরপশু অভিশপ্তদের ঘৃণা করবে বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী। ২৮ অক্টোবর, ২০০৬। একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন কিন্তু বরণীয় নয়। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি কালো অধ্যায়ের সংযোজন। এই দিনের সাথে আজ মিশে আছে স্মৃতি আর বেদনার হাজারো ঘটনা।

২৮ অক্টোবর সংঘটিত ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, বুকলেট, প্রতিবাদ, সিডি, ভিসিডি ও ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। আমার এই লেখাটি তারই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।


২৮ অক্টোবর ২০০৬ ঘটনার শুরু যেভাবে
কেন্দ্রীয় সভাপতি সকাল ১০টার মধ্যে পল্টন কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে সেক্রেটারিয়েট সদস্য ভাইদের আসতে বলেছেন। দু-একজন করে সবাই আসছেন। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার শোনা গেল। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ আমরা কয়েকজন সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখছি অনবরত আহত ও রক্তাক্ত ভাইয়েরা আসছেন। গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের সামনে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে করণীয় ঠিক করা হলো। কেন্দ্রীয় সভাপতি ড.শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিষণ্ন ও যন্ত্রণার চাপ অনুভব করলাম। তাই বুঝতে আর বাকি নেই পরিস্থিতি ভালো নয়। এদিকে ৫ মিনিট যেন ঘণ্টার মর্মবেদনা।

আহত ভাইদের সারি আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে। আর সহ্য করা যায় না। কেন্দ্রীয় সভাপতির হাতের ইশারায় অনুমতি পেয়ে দৌড়াচ্ছি পল্টন মসজিদের গলির দিকে। এদিক থেকে কয়েকজন ভাই ডাকছেন, আসেন ভাই আসেন। তখনও বুঝতে পারিনি সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মনজু ভাইও এখানে আহত। কে যেন বলে উঠল, আহ! মনজু ভাইকে শেষ করে ফেলল। আল্লাহর দ্বীনের এই নির্যাতিত মানুষটির গায়ে আবারও ওরা আঘাত করেছে। তারা তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে তার ওপর লগি-বৈঠার চরম আঘাত চালিয়েছে। লগি-বৈঠার আঘাতে জর্জরিত করেছে সারাটি দেহ। শুধু তাই নয়, এর আগেও তিনি এ রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকবার। যে আঘাতের যন্ত্রণায় তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। এ দৃশ্য দেখতে না দেখতে জড়িয়ে পড়লাম পরিস্থিতি মোকাবেলায়। এক দিকে আমরা ৪০-৫০ জন ভাই, অপর দিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি দিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। যে ইটগুলো তারা আমাদের দিকে মারছে সেইগুলো তুলে আমরা তাদেরকে প্রতিহত করছি। এভাবে একদিকে সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্রের হামলা অন্য দিকে আমরা নিরস্ত্র কিছু কর্মী। এই নিরীহ মানুষগুলোই অস্ত্রে সজ্জিত এই বিরাট বাহিনীকে ৭ ঘণ্টা মোকাবেলা করেছিল। ওরা সকল শক্তি নিয়োগ করেও এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এটাই তো মাবুদের পক্ষ থেকে বান্দাকে সাহায্যে করার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন! এই দৃশ্য তো আল্লাহর দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। বাতিলের বিরুদ্ধে এক চরমপত্র। ১৪ দলের গালে একটি চপেটাঘাত। জীবন দেয়ার প্রতিযোগিতা। ঈমানদারের জন্য এটি বিরাট সুযোগ। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। এই দৃশ্য না দেখলে কি বিশ্বাস করা যায়?

এক সময় আমি নিজেও মনে করতাম অস্ত্রের মোকাবেলায় টিকে থাকা যায় না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় সে ভুল কিছুটা শুধরে নিয়েছি, বাকিটুক পরিশুদ্ধ করেছি ২৮ অক্টোবরের ঘটনায়। আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী! ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হচ্ছে নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। কারণ এই আন্দোলনের বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।

হঠাৎ চিৎকার শুনলাম টুটুল ভাইকে মারছে। এ কথা শুনে উপস্থিত ভাইদের উদ্দেশে বললাম, আপনাদের মধ্যে যারা জীবন থাকা পর্যন্ত পিছিয়ে আসবেন না তারা হাত তুলুন এবং সামনে আসুন। মাত্র ১৫-২০ জন ভাই এগিয়ে এলেন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে। যখন আমরা এগোতে লাগলাম আওয়ামী লীগের ৪-৫ হাজার লোক পেছনের দিকে দৌড়াতে লাগল। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তাঁর সাহায্য অনিবার্য। এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘কোনো একজন মু’মিন মুজাহিদের জিহাদের ময়দানে যখন নারায়ে তাকবির শ্লোগান দেয় তখন তাদের একজনের আওয়াজ বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।’’ ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

যাক, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। হায়েনারা তাকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে ধরে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। তখনো ঠিক বুঝতে পারিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা। এখন মিলিয়ে দেখলাম যে মনজু ভাইয়ের আহত হওয়া আর মুজাহিদের শাহাদাতের ঘটনা ছিল একই সময়। আর এই মুজাহিদই শাহাদাতের আগে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমার প্রিয় দায়িত্বশীল সাবেক কেন্দ্র্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মনজু ভাই’। হজরত তালহা (রা) রাসূলে করিম (সা) কে রক্ষা করার জন্য একাই নিজের শরীরে অসংখ্য তীরকে বরণ করেছিলেন। আর সেই চেনতনায় উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের প্রিয়ভাই শহীদ মুজাহিদ, মাসুম, শিপন আর ফয়সাল নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রিয় দায়িত্বশীলকে রক্ষা করতে গিয়ে। আর হয়তো অনেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে চিৎকার করে বলেছিল আমি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু এখানেই বিদায়!!। তারা সফল। তারা জান্নাতি। এই শহীদ ভাইয়েরা আজ আমাদের দায়িত্বশীল।


এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের গুলি দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা পর আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম হাঁটুর ওপর ভর করে। তৎকালীন সেক্রেটারিয়েট সদস্য জাহেদ হোসেন ভূঁঞা ভাই ও আব্দুল মান্নান ভাইসহ কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে বলে। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলিবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখে। অনেকে দলবেঁধে আমার সাথে আসতে লাগল। কিছুটা ধমকের সুরে বললাম, এতজন কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন। নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতেও দারুণ শৃঙ্খলা এ শহীদ কাফেলার ভাইদের মাঝে। আলহামদুলিল্লাহ!!

এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। নিজেদের কষ্ট হচ্ছে, রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। উনার অবস্থা বেশি খারাপ। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম নমুনা। মদিনার সেই আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলিবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে আমার পায়ের হাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি ডাক্তারকে বললাম, এই গুলিটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলিটি আমার এই পায়ের নামেই লেখা ছিল। ডাক্তার হতবাক হয়েছেন, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ..

২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনায় হয়তো কেউ কেউ বলেন, আমাদের প্রস্তুতির দুর্বলতার কথা। তা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু আমি মনে করি, দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মারামারি করেছি, কী তাদের পরিচয়? দলে তারা আওয়ামী লীগ কিন্তু ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই গার্মেন্টসকর্মী আর পতিতালয়ের হিন্দার উত্তরসূরি। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেত ঠিকই, আর এ ধরনের সন্ত্রাসী, টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেধাবী নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। হিসাব হতো কাদের লাশ কয়টি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেখানো হতো সেভাবে। অন্তত আল্লাহতায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি আর রক্তপিপাসু হায়েনা কারা। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহত। এ বিশ্বাস আমাদের রাখতে হবে।

আল্লাহ বলেন, ‘আর বিপদ-মুসিবত কখনো আমার অনুমতি ব্যতিরেকে আসে না।’ এটিই চিরন্তন সত্য। আমাদের কারো হিসেবে যেটি পরীক্ষা, কেউ আবার একে নিচ্ছেন বিপদ হিসেবে। কেউ নিচ্ছেন পরিশুদ্ধতার সুযোগ হিসেবে। আবার কেউ মনে করেন এটি ই আমাদের পাওনা। এটিই ইসলামী আন্দোলন। ১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিবিদ্ধ হয় রোজাদার শহীদ শফিকুল ইসলাম। হাসপাতালে সবাই চেষ্টা করছেন তাকে সুস্থ করার জন্য। কিন্তু সেদিন শফিকুল ইসলামের আকৃতি ছিল এরূপ, ‘ভাই’! আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি ঠিক, কিন্তু শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষা অনেক দিনের। সুতরাং আমাকে রোজাদার অবস্থায় শহীদ হওয়ার সুযোগটুকু করে দিন।’ এ কথা বলতে বলতে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন। এটাই তো তার প্রস্তুতি!

কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা ১৪ দল কিভাবে করছে। হাসপাতালে শত শত দর্শনার্থী। এতো দর্শনার্থীর ধাক্কায় রোগীরা কাবু কিন্তু করার কিছু-ই নেই। এটি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই আমরা মানুষ। হাসপাতালে আহতদের অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে কেউ কেউ বলতে থাকেন আহ! সেদিনের প্রস্তুতি আরেকটু ভালো হওয়া দরকার ছিল। এতগুলো ফুটফুটে ছেলে আমাদের ভুলের কারণে বিদায় নিল। কেউ আবার আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করছে, আচ্ছা রেজাউল ভাই আপনারা জানতেন না এভাবে হামলা হবে? আবার কেউ কেউ বলছেন, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আওয়ামী লীগ আবার ’৭২, ’৭৩-এর বাকশালী চরিত্রের বহিংঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।

কেউ কেউ বলছে, এই ঘটনার পর অনেকেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একজন দর্শনার্থী ভাই অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে হঠাৎ করে হাসপাতালে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে আরেক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। এ হচ্ছে আবেগ আর মানবীয় পর্যালোচনার হিসাব নিকাশ। আল্লাহর হিসাব তো ভিন্ন। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ, মাসুম, শিপন, মুজাহিদ, রফিক, ফয়সালের পরিবার। কিন্তু না। এটি আপনার হিসাব হতে পারে। তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতি ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য। তারপরও শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের ফরিয়াদ : আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো, মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো। শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের গর্বিত মায়ের আহ্বান : আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালেদ বিন ওয়ালিদ হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইনের মত হবে। আমার আরেক ছেলে শামসুল আলম মাহবুব। সবসময় দোয়া করতাম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা যেন গাজী কিংবা শহীদ হয়। সত্যি আমার প্রার্থনা আল্লাহপাক কবুল করেছেন। আমি মনেপ্রাণে সর্বদা আশা পোষণ করতাম মাসুম যেন ময়দানে সবার আগে থাকে। আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সবসময় করি। শহীদ ফয়সালের গর্বিত মা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ঠিক এভাবে : তাদের কথা শুনেই মনে হয় তারা সত্যিই হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর উত্তরসূরি। হজরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর পথে কুরবান করে হজরত ইব্রাহিম (আ) যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী, ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। শহীদ রফিকুল ইসলামের পিতার চাওয়া : আমার ছেলে আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কুড়িগ্রামবাসী সবাই তার জন্য কেঁদেছে। জীবনে সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়নি। সে সবসময় সৎ সঙ্গে মিশত এবং দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকত। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, লাশের ওপর নৃত্যউল্লাস করেছে, ভেঙে দিয়েছে দাঁত, উপড়ে ফেলেছে চোখ; তারা হয়তো বা ভাবতে পারে এর মধ্য দিয়ে তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ এই পৃথিবীতেই শেষ নয়। বরং তাদের এই একটি আঘাত আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের কাছে জান্নাতের নিকটবর্তী। যারা আঘাতের পর আঘাত চালিয়েছে এ নিষ্পাপ মানুষের দেহে, তারা কি আজ উত্তর দিতে পারবেন হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের জিজ্ঞাসারÑ ‘কী অপরাধ আমার সন্তানের? তাকে হত্যা করা হয়েছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। এ জন্য আমি গর্বিত। কিন্তু কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সন্তানের দাঁতগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে? এই মুখ দিয়ে তো সে মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুখস্থ করেছে। যাদের বুকের ওপর নৃত্যউল্লাস করা হয়েছে, তারা কি জানে যে কপালে লাথি মারা হয়েছে সে কপালে দিনে পাঁচবার করে আল্লাহকে সেজদা করতো! পড়তো তাহাজ্জুদ নামাজ। যে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে সে হাত দিয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতো, যে পা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে পা দিয়ে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতে যেত। এ হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব আজ তাদের কাছে আছে কি? যারা সেদিন আমাদেরকে পিছিয়ে দিতে এসেছে তারা আমাদেরকে অনেক পথ এগিয়ে দিয়েছে। আরেকবার আমরা দেখে নিয়েছি আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। যাদের সাহস আমাদের এগিয়ে দেয়। যাদের আল্লাহর নির্ভরতা এ কাফেলার কর্মীদের আশান্বিত করে। যাদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা দেখেছি তাদেরকে। আমরা দেখেছি তাকে যাকে ঘিরে এ জনসভার আয়োজন। শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত, বিশ্ব নন্দিত নেতা, সাবেক সফলমন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। কিন্তু ধৈর্যের মাপে উত্তীর্ণ। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতিচ্ছবি। এমনি এক জনসভায় অবিরাম গুলিবর্ষণ চলাকালে মাওলানা মওদূদীকে বসে পড়ার জন্য অন্যরা অনুরোধ করলে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমিই যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাই বিশ্বাস শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, একদিন কথা বলবেই। একদিন এই জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবেই, ইনশাআল্লাহ।

২৮ অক্টোবর আওয়ামী নরপশুরা যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে হত্যা করেছে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে এই রকম আরেকটি ঘটনা বিরল। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের এমন জঘন্য ইতিহাস নতুন হলেও আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক জীবনের তার পুনরাবৃত্তি করেছে অসংখ্যবার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই আওয়ামী লীগ সিরাজ শিকদারসহ ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যার জঘন্য ইতিহাস তৈরি করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সংসদের স্পিকার ও সংসদ সদস্য হত্যার খারাপ দৃষ্টান্ত সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় নাটোর ও নরসিংন্দীর নির্বাচিত উপজেলা চেয়্যারম্যান হত্যা, সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী, শিবিরের ২জন ছাত্রনেতাসহ শতাধিক ব্যক্তির গুম হওয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য যুদ্ধাপরাধ বিচাররের নামে প্রহসন আওয়ামী লীগের পুরনো জঘন্য চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। কয়লা ধুয়ে যেমনি ময়লা যায় না তেমনি আওয়ামী লীগের চরিত্রের আজ পরিবর্তন হয়নি। এই জন্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বাকশাল থেকে সরে এলেও আমরা চিন্তা চেতনায় এখনো বাকশালই লালন করি।”

এইবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে-বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, হত্যা, গুম, রাহাজানি নিত্যনৈমিত্তিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর জুলুম নিযাতন গোটা দেশকে কারাগারে পরিণত করেছে। তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সংখ্যাধিক্যের দাপটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী ও জামালপুরের হাফেজ রমজান আলীকে দিয়ে খুনের কর্মসূচি শুরু করে ৩৫ মেধাবী ছাত্রকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দেশের শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও আক্রান্ত। ছাত্রশিবিরের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে এবং অনেক নেতা কমীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলেও তা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেয়ার ঘটনা সরকারের নব্য বাকশালী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আমি বিশ্বাস করি শহীদের রক্ত কথা বলে, এ রক্তের আছে নিজস্ব শক্তি। ২৮ অক্টোবর ও ২৫, ২৬ ফেব্র“য়ারি সেনাসদস্যদের রক্তের বেড়াজাল থেকে আওয়ামী লীগ কখনও রেহাই পাবে না। আওয়ামী লীগ এখন দেশে –বিদেশে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, চোর বাটপার, আর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। এই অপকর্মের বোঝা আর শহীদের পিতা-মাতার বিনিদ্র রজনীর চোখের পানি, গুম, খুন হওয়া পরিবারগুলোর আর্তনাত আর কারাগারের চার দেয়ালে আবদ্ধ প্রতিটি মজলুমের ফরিয়াদ আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে সেদিন বেশি দূরে নয়….


লেখক : ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
সহ-সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
[email protected]

সংশ্লিষ্ট