সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪

ডা. মো: ফখরুদ্দিন মানিক

২৮ অক্টোবর : অপরাজনীতির দলিল

Fascism যার বাংলা অর্থ ফ্যাসিবাদ, এ শব্দটি বিশ শতকের শুরু থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক বা তারও কিছু পূর্ব থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকজন প্রচণ্ড রকমের স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন তাদের নাম এবং দলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে Fascism-এর স্বরূপটি ফুটে ওঠে।
মূলত Fascism-এর সাথে স্বৈরাচারী অথবা জুলুমবাজের প্রচণ্ড মিল। শুধু মিলই নয়, Fascism-এর সংজ্ঞা এবং এর বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে স্বৈরাচার, জুলুমবাজ, জোরপূর্বক মতা দখল, বিরোধীদের দমন এবং দলনকারী, চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকারী এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারী অথবা গণতন্ত্র হত্যাকারী এই শব্দগুলোই পাওয়া যায়। জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনী এবং ফ্রান্সের নেপোলিয়ান এক একজন সফল রাষ্ট্রপ্রধান অথবা সফল সেনানায়ক হিসেবে যতটুকু পরিচিত বরং তার চাইতে বেশি পরিচিত একজন স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে।

সেই জন্যে নাৎসী বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, মাইলাই হত্যাকাণ্ড, জ্যালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডসমূহ পৃথিবীর ইতিহাসে এই সকল স্বৈরশাসকদের খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত করেছে।
সেই হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সেই রকম একটি ফ্যাসিবাদী দল হিসাবেই তার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে বিভিন্নভাবে। Fascism Gi Definition-এ বলা হয়েছে, “It is the rulership of a country through arrogant and racist dictatorship”. যাতে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক স্বৈরতন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট। অপর এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: ‘A government system lead by a dictator having complete power, forcibly suppressing opposition to criticism regimenting all.’

সমালোচকরা অথবা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগকে সেই রকমই একটি দল এবং তাদের পরিচালিত সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার বলে থাকেন। এই প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের এহেন চরিত্রটি অজানা থাকলেও বিগত ১৯৯৬-২০০১ সালে শাসনব্যবস্থা এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মতায় আরোহণের পর দীর্ঘ ৩৩ মাসের শাসন এ প্রজন্মের কাছে দুঃশাসন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা সারা বাংলাদেশ থেকে এসে যে তাণ্ডবলীলা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এটি শুধু আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেনি বরং আওয়ামী লীগ তার দানবীয় এবং পাশবিক চরিত্রকে এ জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে কোন কারণ ছাড়াই বিনা উসকানিতে পুলিশের সামনে যারা নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, মৃত লাশের ওপর উল্লাসনৃত্য অন্ধকার যুগের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। সারা বিশ্ববাসী স্তম্ভিত এবং হতবাক হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছে এরা কারা? এটি কি মানুষের কাজ? তাদের কাছে কি সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানবতা বলতে কিছু নেই? কী নিষ্ঠুরতা?
কবির ভাষায়-
‘এ কোন্ শয়তান মানুষের সত্তাকে করে চরম পরিহাস
কোন্ আজাজিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে।’
সত্যিই আওয়ামী লীগের ইতিহাস যুতটুকু তাতে সভ্যতা সংস্কৃতি অথবা মানবতা এবং গণতন্ত্র পাওয়া উকুনের চোখ খোঁজার মত।

২০০৬ সালে ২৮ শে অক্টোবর ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর মেয়াদ শেষে মতা হস্তান্তরের দিন। সেই উপলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকারমের উত্তর গেটে সমাবেশের আয়োজন করে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা, তাই সকাল থেকে শুরু হয়েছিল ডেকোরেশনের কাজ। অল্প কিছু ভাই স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিল। ক্রমান্বয়ে চলছিল স্টেজ তৈরির কাজ, সেই সাথে শৃঙ্খলা বিভাগের কর্মীদের নিধারিত স্থানে সেট করা। সকাল ১০টার দিকে আমরা তখন শেষবারের মত সবাইকে যার যার নির্ধারিত জায়গায় ঠিকভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য পল্টন মসজিদের গলিতে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করে দেখি কাকরাইল নাইটিঙ্গেলের দিক থেকে একটি বড় মিছিল যার অধিকাংশই ছিল লুঙ্গি পরা, হাতে লগি এবং বৈঠা দেখে মনে হয় যেন কোন চর দখলের জন্য এক বিরাট লাঠিয়াল বাহিনী চেহারায় ছিল উন্মত্ততা এবং তাদের নেতাদের নির্দেশ পালনের হিংস্রতা। কারণ তার কয়েকদিন আগেই মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশ থেকে তাদের সকল কর্মীকে লগি এবং বৈঠা নিয়ে ঢাকার রাজপথ দখল করার আহ্বান জানান। সেই জন্য তারাও নেত্রীর নির্দেশ পালনের জন্য সবাই সেদিন রাজধানীতে জড়ো হয়। মিছিলের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল দেশের সবগুলো সন্ত্রাসীকে ভাড়া করা হয়েছিল এই মিছিলের জন্য।

হঠাৎ করে মিছিলের একটি অংশ কোন কারণ ছাড়াই বিনা উসকানিতে পল্টন মসজিদের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কর্মীদের আঘাত করতে শুরু করে। সাথে সাথে আহত এবং রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে আমাদের কয়েকজন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমরা কিছুটা পেছনে সরে এসে শ্লোগান দিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা সবাই গলি থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যায়। এইভাবে কিছুক্ষণ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর দেখি অব্যাহত মিছিলের একটি অংশ পল্টন মোড়ে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত ভাইদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের অব্যাহত আক্রমণ ইট, পাথর বৃষ্টির ধাওয়ার মধ্যে এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, হাবীব, মাসুম ও ফয়সাল। তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে আহত, রক্তাক্ত ও বুলেটবিদ্ধ হন ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য নেতাকর্মী। এ যেন আরেক কারবালা! এ কোন রাজনৈতিক অপকৌশল! তিন দিক থেকে আক্রমণ করে আমাদের সমাবেশকে পণ্ড করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। নাইটেঙ্গেলের দিক থেকে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে, প্রেস কাবের দিক থেকে মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ডা: এইচবিএম ইকবালের নেতৃত্বে এবং মুক্তাঙ্গনের দিক থেকে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। বেলা যতই বাড়ছিল আক্রমণের তীব্রতাও ততই বাড়ছিল। ততণে জামায়াত অফিস, শিবির অফিস, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল আহত ভাইদের দ্বারা ভর্তি। কোথাও একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই, যে ২০-২৫ জন নিয়ে সকাল ১০টা থেকে পল্টনের গলিতে ছিলাম, মোটামুটি সবাই আহত।

মুজাহিদকে পিটিয়ে শহীদ করে গলিতে ফেলে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর দেখি আমান ভাইকে রাস্তায় ফেলে খুবই পেটাচ্ছে, তখন যে কয়জন সাথে ছিল তাদেরকে সাথে নিয়ে আমান ভাইকে উদ্ধার করি। সমস্ত শরীর তার রক্তাক্ত, চেনা যাচ্ছে না অথচ পড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি খুব চিৎকার করে সবাইকে একত্রিত করার জন্য বলেছিলেন, বলেছিলেন স্লোগান দেয়ার জন্য, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য; কিছুক্ষণ পর দেখি একজন ভাই তাদের মধ্য থেকে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছেন, কাছে আসার পর দেখি তিনি আর কেহ নন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মন্জু ভাই। আমাদের কাছে এসে তিনি পড়ে যান। পরে জেনেছিলাম তিনি তাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছিলেন। অসংখ্য আঘাতের পর কোন রকম সুযোগ পেয়ে দৌড়ে আসছিলেন। পরে কয়েক ভাই উনাকে উদ্ধার করে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেন। সেই দিন পল্টনকে মনে হয়েছিল অন্য রকম এক জিহাদের ময়দান। আমরা বদর, ওহুদ এবং খন্দকে রাসূল (সা) এর সাথে সাহাবীদের ইতিহাস পড়েছি। পড়েছি হামজা, হানজালা (রা)-দের বীরত্ব এবং দৃঢ়তার কথা, কাফেরদের সংখ্যাধিক্য এবং অত্যাধিক অস্ত্র এবং রশদ যাদেরকে সামান্যতম বিচলিত করেনি এবং নিজেদের সামান্য প্রস্তুতি এবং ঈমানের কঠিন মজবুতি নিয়ে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে রাসূল (সা) এর সাথে অটল এবং অবিচল ছিলেন। কাফেরদের সেই বৃহৎ সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইয়েরা সেই ঈমানী দৃঢ়তা নিয়ে আওয়ামী অপশক্তি তথা মহাজোটের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নিজের পাশের ভাইটি রক্তাক্ত, আহত হয়ে পড়ে যাওয়ার পর নিজে এতটুকু ভীত বা বিচলিত হননি। আওয়ামী লীগের নিক্ষিপ্ত ইট, পাথর, বোতল, লাঠিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করেছেন।

প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর হঠাৎ একটি ইট মাথায় পড়ে। কানের পাশ দিয়ে পড়া রক্তকে প্রথমে ঘাম মনে করে তখনও দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু পাশের ভাইয়েরা তখনি ধরে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এখানে এসে দেখলাম আরেক করুণ দৃশ্য! অসংখ্য আহত ভাইয়ের চিৎকার এবং আর্তনাদ, তার সাথে রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালবাসার এক অনন্য নজির। এ যেন সেই ইয়ারমুক যুদ্ধের ময়দান, যেখানে পিপাসার্ত মুসলিম সৈন্যরা নিজের পিপাসাকে সংবরণ করে পানি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অপর ভাইয়ের কাছে, এখানেও তাই। নিজেই আহত অথচ রক্তাক্ত জখম নিয়ে সেবা করছেন, অপর ভাইয়ের ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন, ড্রেসিং করে দিচ্ছেন, আঘাতের জায়গায় বরফ লাগিয়ে দিচ্ছেন। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম যাদের সবাইকে নিয়ে সকালে শৃঙ্খলার জন্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের অধিকাংশই এখানে। রাস্তায় থাকায় তখনও বুঝতে পারিনি কোথায় কতটুকু আঘাত লেগেছিল। এখানে বসার পর আস্তে আস্তে দেখি সবগুলো জয়েন্ট থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক জায়গাই আহত এবং রক্তাক্ত। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি স্ক্রিনটা ফেটে গেছে। অনেক মিস কল। আমার আঘাতটা বেশি মারাত্মক না হওয়ায় হালকা ব্যান্ডেজ নিয়ে নিচে নেমে এসে আযাদ প্রোডাক্টসের গলিতে অবস্থান করি। তখনও শোনা যাচ্ছে ধ্রিম ধ্রিম বোমার আওয়াজ আর আহত ভাইদের মিছিল। যথানিয়মে জামায়াতের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পল্টন মোড়ের কিছু পেছনে আমাদের ভাইয়েরা মানববর্ম তৈরি করে মহাজোটের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করছে আর এক এক করে আহত হয়ে ফিরে আসছে। এর মধ্যে খবর এসেছে আওয়ামী লীগের হামলায় শাহাদাত বরণ করেছেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, রফিক ফয়সাল ও হাবীব। আমীরে জামায়াতের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, কণ্ঠে দৃঢ়তা। ৬ জন ভাইয়ের শাহাদাত এবং হাজার হাজার ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শোনার পরও তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান।

কোন রকম হঠকারী বা উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি অথচ যার একটি মাত্র আঙ্গুলি হেলনে হাজার হাজার কর্মী শাহাদাত বরণ করতে দ্বিধা করবেন না, ঠিক সেই মুহূর্তেও আমীরে জামায়াত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য বক্তব্যের মাধ্যমে আহবান জানাচ্ছেন। এই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন তথা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতার দেশপ্রেম এবং দায়িত্বশীলতা। ঠিক একই রকম বক্তব্য এসেছিল বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেল ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে। বিকেলে একটি ছেলেকে আমাদের ভাইয়েরা ইনফরমার হিসেবে আটক করে আযাদ হোটেলের সামনে যখন মারার জন্য এগিয়ে আসে। সেক্রেটারি জোনারেল সব শুনে তাকে ছেড়ে দেন এবং বলেন আমরা যদি এরকম আচরণ করি তাহলে আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? অথচ ইতিহাস সাক্ষী এবং ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছে বাংলাদেশের মানবতার বিপর্যয়, যার মূল উসকানি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন। তিনি এক সময় ২০০১ সালে চট্টগ্রাম গিয়ে জনসভায় প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, একটি লাশের বদলে ১০টি লাশ, কর্মীদের উসকানি দেন এই বলে, চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা শাড়ি-চুড়ি পরে বসে আছে। অথচ তিনি ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা ধিক্কার জানাই এসব নেতাকে যারা তাদের কর্মীদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাস নির্মূল অথবা নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উসকে দেন। সত্যিকারার্থে তাদের কর্মতৎপরতা দেশের কতটুকু কল্যাণের এটি আজকে বড় প্রশ্ন। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে শেষ হলো ১৪ দলীয় মহাজোটের ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের এই তাণ্ডব এবং ধ্বংসলীলায় প্রাণ হারাল ইসলামী ছাত্রশিবিরের মুজাহিদ শিপন, মাসুম, ফয়সাল রফিকসহ ইসলামী আন্দোলনের ১৪ জন ভাই। আমাদের মায়েরা হারালেন তাদের নাড়িছেঁড়া ধন প্রিয় সন্তানকে, দেশ হারালো কিছু সম্ভাবনাময়ী তরুণ এবং আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক কিছু নাগরিক।

২৮ অক্টোবরের পর আজকে ৫ম বছরে পদার্পণ করেছে, এখনও বিচার হয়নি সেই দিনের, সেই নরঘাতকদের। সারা বিশ্ববাসী দৃশ্যগুলো দেখার পর যেখানে ‘স্টপ জেনোসাইড’ এই চিৎকারের পাশাপাশি মানবতার বিপর্যয়কারী সন্ত্রাসীদের বিচারের দাবি উঠলেও অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে মহাজোট সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় এই মামলাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের এই মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে একদিকে মানবতাকে লাঞ্ছিত করেছে, আহত নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ, ছেলে হারা, স্বামী হারা, মা-বোনদের হৃদয়ের আকুতিকে পদদলিত করেছে। আর সেই জন্য ২৮ অক্টোবরের মত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে নাটোরে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বড়াইগ্রামে যেখানে ঠিক একই কায়দায় ৮ অক্টোবর’১০ রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করেছে উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে। প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল সন্ত্রাস। সুতরাং আজকে সময়ের দাবি হচ্ছে, ২৮ অক্টোবরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যথায় সরকারকে এর চরম মূল্য দিতে হবে কারণ আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুধুমাত্র প্রতিপকেই ঘায়েল করছে না বরং বিগত ৩৩ মাসে তাদের হাতে তাদের নেতাকর্মীই নিহত হয়েছে অসংখ্য। আজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগের অপরাজনীতির কারণে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য এবং কলুষিত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, ভর্তি-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, টেন্ডার ও চাঁদাবাজি আজ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর সরকারও এ সকল সমস্যা এবং জনদুর্ভোগগুলো সমাধানের পরিবর্তে এক ধরনের গ্রেট গেইমে নিয়োজিত। যার অংশ হিসাবে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, হয়রানি, আধুনিক শিক্ষানীতির নামে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের নামে ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের ওপর নগ্ন আঘাত হানার চেষ্টা করছে, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা-বিশ্বাস বাদ দিয়ে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের বিকৃত বাংলা অনুবাদ, গোপালগঞ্জ এবং ঢাকার শেরে বাংলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের হিন্দু শিকের রাসূল (সা) সম্পর্কে কটূক্তির প্রশ্রয়দান, যা দেশের আপামর জনসাধারণের চিন্তা-চেতনা, ঈমান-আকিদা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। বেআইনীভাবে আমাদের নেতৃবৃন্দেকে মিথ্যা অজুহাতে এবং বিনা অভিযোগে গ্রেফতার করে সরকার যদি এটিকে ইসলামী আন্দোলন নির্মূলের টেস্ট কেস হিসেবে নিয়ে থাকেন তবে এটিও জেনে রাখা উচিত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের শরীরে এক ফোটা রক্ত বাকী থাকতে আমরা এই ষড়যন্ত্রকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেব না।
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা তা মোকাবেলা করব। সরকারের আরো জানা উচিত দেশের মানুষের চিন্তার বিপরীতে গিয়ে কোন স্বৈরশাসকই বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি, আজকের তিউনিশিয়ার জয়নুল আবেদীন বেন আলী, মিশরের হোসনে মোবারক লিবিয়ার গাদ্দাফীর চরম পরিনতি তারই প্রমাণ বহন করে।। দুনিয়ার কোন শাসক যতটুকুই উদ্ধত্ব প্রকাশ করুক কিন্তু আল্লাহর সীমাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা বা শক্তি রাখেন না। সুতরাং আজকে রাজনৈতিক বিবেচনায় যাই করেন না কেন একদিন অবশ্যই আপনাদেরকে জনতার আদালতে এবং আল্লাহর আদালতে হাজির হতেই হবে। আল্লাহর আদালত থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না আর জুলুম নির্যাতন করে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে আটক করে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দেয়া ইতঃপূর্বে যেমন কোন জালেম অথবা ইসলামবিরোধী শক্তির দ্বারা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না, বরং জুলুম, নির্যাতন এবং ঈমানী পরীক্ষার এই শাশ্বত কঠিন পথ ধরে অবধারিত সোনালি সূর্য একদিন উদিত হবেই ইনশাআল্লাহ। তাই আমরা বলছি-
‘‘আমাদের গতি সত্যের পথে
কোন বাধা আজ মানবে না
বিজয় আছে সম্মুখে তাই
মুক্তির এ মিছিল থামবে না।”


লেখক : ডা. মো: ফখরুদ্দিন মানিক
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

সংশ্লিষ্ট